কেউ কেউ তাকে ‘সিক্রেট সুপারস্টার’ হিসেবে মানেন। যার মাঠের পারফরমেন্স বরাবরই ঢাকা পড়ে যায় কারো না কারো খ্যাতির পেছনে। দীর্ঘ দশ বছরের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে যার আহামরি কোনো রেকর্ড নেই। মারকুটে ব্যাটিং করে দর্শকদের মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে আসতে পারেননি। বাইশ গজের উইকেটে দাঁড়িয়ে খুব কমবারই ব্যাট উঁচিয়ে ধরতে পেরেছেন। তিনি আর কেউ নন, ক্রিকেট বাংলাদেশের সিক্রেট সুপারস্টার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ।
২০০৭ সালের জুলাই মাসে বাংলাদেশ দল শ্রীলংকা সফরে গেল। সুযোগ পেলেন তরুণ তুর্কি মাহমুদুল্লাহ। মূল একাদশের হয়ে মাঠে নামলেন তৃতীয় একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে। টার্গেট মাত্র ১৯৭। বৃষ্টি বিঘ্নিত ম্যাচে ৪০ ওভারে এই রান তুলতে হবে বাংলাদেশকে। এর আগে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামের বোলিং সহায়ক উইকেটে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কা খুব ভুগেছে। বাঁহাতি জিহান মোবারক ছাড়া আর কেউ তেমন সুবিধা করতে পারেননি। তবে কি টাইগারদের কপালেও শনির দশা আছে?
স্কোরবোর্ডই কথা বলল। ৬৯ রানের মাথায় সফরকারীরা তাদের ৫ম উইকেট হারিয়ে বসেছে। ক্রিজে এলেন অভিষিক্ত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। অভিজ্ঞতা বলতে অনেকদিন ধরেই মিডল অর্ডার ব্যাটসম্যান হিসেবে এ দলে খেলেছেন। খারাপ অবস্থায় দলের হাল ধরার অভ্যাস আছে। ব্যতিক্রম হলো না এদিনও। ধীর গতির উইকেটে ৫৪ বলে খেললেন মাত্র ৩৬ রানের ইনিংস। সতীর্থ তামিম ইকবালের সাথে ৬০ রানের এক অনবদ্য জুটি গড়ে জয়ের আশা বাঁচিয়ে রেখেছিলেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।
বোধহয় এই ভেবে হয়নি যে, আরেকজন নেপথ্যে নায়কের জন্ম এই ম্যাচের হাত ধরেই হলো। যার অবদান কিনা সবসময়ই চাকচিক্যের পেছনে আড়াল হয়েই থাকবে। যেমন এই ম্যাচে তামিমের ৫৪ রানের ইনিংসটি তার ছোট্ট অথচ কার্যকরী চেষ্টাটি ঢেকে দিয়েছিল।
এর পরের নাটকটি ২০০৯ সালের। সেন্ট ভিনসেন্টের আরনোস ভ্যালে গ্রাউন্ডে টস জিতে বাংলাদেশ ব্যাটিং করার সিদ্ধান্ত নিলো। ম্যাচটি আর কারো না হোক, অবশ্যই রিয়াদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ। কেননা প্রথমবার সাদা পোশাকে মাঠে নামার অনুভূতি কেমন- জানা নেই তার। ঐদিকে ওয়েষ্ট ইন্ডিজ দলে আমূল পরিবর্তন এসেছে। বোর্ডের সাথে মতের মিল না হওয়ায় নিয়মিত প্রায় সকল খেলোয়াড়ই সিরিজ বয়কট করে বসলেন। এমতবস্থায় সফরটিই বাতিল হবার কথা। কিন্তু নির্বাচকরা আস্থা রাখলেন পাইপলাইনে থাকা বিকল্প খেলোয়াড়দের ওপর। সেদিন কিংস্টনে দুই দলের মোট ৯ জন খেলোয়াড়ের অভিষেক হয়। বাংলাদেশের পক্ষে প্রথমবার টেস্ট খেলতে নামেন মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ ও রুবেল হোসেন। আনকোরা বাকি ৭ খেলোয়ার ক্যারিবিয়ানদের পক্ষে।
প্রথম ইনিংসে সফরকারীরা মাত্র ২৩৮ রানে অলআউট হয়ে গেল। আতঙ্কের নাম ক্রেমার রোচ। গতি, বাউন্সার- দুটোর ধারই মাশরাফি বাহিনী সামলাতে পারল না। তবু শেষপর্যন্ত মান বাঁচালেন লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যানরা। জবাবে ৩০৭ রানে থামে স্বাগতিকদের প্রথম ইনিংস। সর্বোচ্চ তিন উইকেট করে নেন আভিষিক্ত রিয়াদ, রুবেল।
বাংলাদেশ দ্বিতীয় ইনিংস শুরু করে তামিম ইকবালের সেঞ্চুরির ওপর ভর করে। বাকি ব্যাটসম্যানরা তাকে যোগ্য সঙ্গ দিতে পারলে হয়তো গল্পটা অন্যরকম হতো। দারুণ ছন্দে থাকা রিয়াদের ব্যাট এবারও অনুজ্জল। কিন্তু বোলিংয়ে মাত করলেন আবারো। ক্যারিবিয়ানদের দ্বিতীয় ইনিংসে ১৮১ রানে অলআউট করার পেছনে তার অবদান অনস্বীকার্য। ডান হতের ঘুর্ণির জাদুতে গুনে গুনে ফেরালেন পাঁচ বাটসম্যানকে। বাংলাদেশ জিতল ৯৫ রানে। ম্যাচে ৮ উইকেট নিলেন অভিষিক্ত মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। বলা চলে, শুরু থেকে ম্যাচের ব্যবধান তৈরি করেছিলেন বোলাররাই। কিন্তু শেষপর্যন্ত নায়ক সেই একজন ব্যাটসম্যান। তামিমের ঝকঝকে ১২৮ রানের ইনিংসটির আড়ালে চাপা পড়ে গেল ১৫-৪-৫১-৫ সমীকরণের অসাধারণ বোলিং ফিগারটি।
এভাবেই শুরু হয়েছে তার ক্যারিয়ার। দিন যায়, রিয়াদ আরো পরিণত হয়ে ওঠেন। হাবিবুল বাশারের অবসরের পর নির্বাচকরা বোধহয় শঙ্কায় ছিলেন- আরেকজন বাশার কি বের হবে কখনো? মিডল অর্ডারে ভরসা করার মতো আসলেই কি কেউ ছিল তখন? সাকিব-মুশফিক তখনো নিজেদের ধারাবাহিক করতে পারেননি।
অভিজ্ঞ আশরাফুলও যেন নিজের পুরনো রূপ ফিরে পেতে মরিয়া হয়েছিলেন। কিন্তু ফলাফল যে সেই। ঠিক সেই সময় একজন নেপথ্যে নায়কের উত্থানও বাংলাদেশ দলের জন্য কম কিছু নয়। মনে আছে, ২০১১ সালে ঘরের মাটিতে ওয়ার্ল্ড কাপের কথা? ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হাল ছেড়ে দেয়া ম্যাচটিও কি নিপুণ দক্ষতায় বের করে এনেছিলেন। কার ভরসায় সেদিন শফিউলের ব্যাট অমন চওড়া হয়েছিল- ক্রিকেট বোদ্ধাদের আর বুঝতে বাকি নেই।
এদিন ৯ম উইকেট জুটিতে রিয়াদ-শফিউলের সংগ্রহ ৪৭ বলে ৫০ রান। ম্যাচ শেষে রিয়াদ অপরাজিত থাকেন মাত্র ২১ রানে। হোক ছোট স্কোর, কিন্তু তা ছিল অাবশ্যকীয়। সাথে বোলিং করে পেয়েছেন একটি উইকেট। আপাত দৃষ্টিতে অলরাউন্ডার পারফরমেন্স। পরে দেখা গেল- ঐ ম্যাচের নায়ক আসলে ওপেনার ইমরুল কায়েস। যিনি কিনা ১০০ বল মোকাবেলা করে ৬০ রানের একটি ইনিংস খেলেছেন। আবার দলীয় স্কোর সুবিধা জনক পর্যায়ে উন্নীত করার আগেই নিজের উইকেট বিলিয়ে এসেছেন।
ক্রিকেটীয় নিয়মনীতিগুলো বড়ই গোলমেলে। যে একসময় প্রতিপক্ষের হাতে ম্যাচ তুলে দিয়ে এসেছিল, ম্যাচ শেষে তার হাতেই ট্রফি তুলে দেওয়া হলো। কিন্তু তার জন্য রিয়াদের আফসোস কই! বরং তিনি খেলে যেতে পারলেই খুশি। দলের একেকটা জয়ের জন্য জানপ্রাণ দিয়ে লড়াই করার সুযোগ পাচ্ছে, তাই যেন এক তৃপ্তির নাম। যে তৃপ্তিকেই তিনি সান্তনা হিসেবে নিয়েছিলেন, যখন এশিয়া কাপে মাত্র ২ রানের হার খুব কাছ থেকে দেখার কারণে তাকে কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়। কোন এক সাক্ষাৎকারে রিয়াদ বলেছিলেন- “নিজের তরফ থেকে হান্ড্রেড পারসেন্ট অ্যাফোর্ড দিয়ে দলকে জেতাতে পারলে ভালো লাগে, কিন্তু কখনো হাইলাইটেড হবার ইচ্ছে জাগেনি। আক্ষেপ বলতে- কেবল সেই দুটো রান না তুলতে পারার অক্ষমতা।”
সুযোগ পেলেই আমি-আপনি যখন রিয়াদের মুন্ডুপাত করছি, তখন তিনি নিজের ভেতরই পুষে রেখেছে সেই আগুন। যে আক্ষেপই তার এগিয়ে চলার শক্তি। ২০১০ সালে হ্যামিল্টন টেস্টের কথা ভোলেনি কেউ। প্রথম ইনিংসে স্বাগতিকদের ৫৫৩ রানের জবাবে ১৯৬ রানে ৬ষ্ঠ উইকেট হারায় বাংলাদেশ। সেখান থেকে ৮ নম্বরে নেমে সতীর্থ সাকিব আল হাসানের সাথে ১৪৫ রানের জুটি গড়েন। সাকিব ৮৭ রানে নিজের উইকেট খোয়ালেও ১১৫ রানের ইনিংস খেলে রিয়াদ তার টেস্ট ক্যারিয়ারের প্রথম শতক তুলে নেন। সেদিন সেডন পার্কের গ্যালারি ভর্তি দর্শক দেখে ফেলে তার ব্যাটের যাদু।
দ্বিতীয় ইনিংসের গল্পটাও একই। সর্বোচ্চ ৬৮ রানের জুটিটি সেই সাকিব-রিয়াদের। দিনশেষে সফরকারীরা হারে ১২১ রানে। ম্যাচের নায়ক মার্টিন গাপটিল। বাংলাদেশের পক্ষে অর্জন বলতে সাকিব, রিয়াদের দুটি সেঞ্চুরি। দল হেরেছে, সুতরাং সেগুলো হাইলাইটেড হবার মতো কিছু নয় নিশ্চয়ই! ৭ কিংবা ৮ নম্বরে নেমে আর যাই হোক, নিজেকে ঠিকঠাকভাবে উপস্থাপন করার সুযোগ থাকে না। একটা সময় এমন ছিল যে, টপঅর্ডাররা বরাবরই ইনিংস শুরুর আগেই নিজেদের বিলিয়ে দিয়ে এসেছে। শেষতক হাল ধরতে হয়েছে সেই মিডল অর্ডার কিংবা কদাচিৎ লেয়ার অর্ডারের। কিন্তু দিন বদলেছে। ক্ষেত্রবিশেষে এখন ৫, ৬, ৭ নম্বরে নেমে কোনোভাবে স্লগ ওভার খেলে আসতে হচ্ছে।
১৯৮৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারিতে ময়মনসিংহ সদরের ধোপাখোলায় জন্ম মাহমুদুল্লাহর। শান্ত স্বভাবের রিয়াদ নিজেকে প্রমাণ করার প্ল্যাটফর্ম পেলেন ২০১৫ এর বিশ্বকাপে। টিম ম্যানেজমেন্ট, কোচের সিদ্ধান্তে তাকে ৪ নম্বরে বাজিয়ে দেখার কথা বলা হয়। কিন্তু তিনি তো মাহমুদুল্লাহ। দলের প্রয়োজনের পিঠে কথা নয়, প্রমাণ দিতে ভালোবাসেন। অ্যাডিলেডে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে তার ব্যাটের পুরুত্ত্ব বিশ্ববাসী দেখেছে। এই একটামাত্র ম্যাচে তিনি ছিলেন সত্যিকারের নায়কের ভূমিকায়। নিজের একমাত্র এবং প্রথম কোন বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বকাপে সেঞ্চুরি করলেন।
নিজেদের কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত করার দিন ‘মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ’ নামটি সবার মুখে মুখে। সেটাই যেন আরেক কাঠি ওপরে তুলে আনলেন নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরের ম্যাচেই। হ্যামিলটনের দর্শকদের মুখে কালো ছায়া ফেলে দিয়েছিলেন টানা দ্বিতীয় সেঞ্চুরি করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এদিন হারের স্বাদ পেতে হয়েছে টাইগার বাহিনীকে। প্রতিপক্ষের জয়োল্লাসের পেছনে ধামাচাপা দিতে হলো ১২৩ বলে ১২৮ রানের দুর্দান্ত ইনিংসটি।
এরপর ঘরের মাটিতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সিরিজ জেতার পেছনে রয়েছে তার নিরব অবদান। যা কেবল স্কোরকার্ডেই আটকে আছে। এই সেদিনের কথা, চ্যাম্পিয়ন ট্রফিতে সেই নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষেই হেরে যাওয়া ম্যাচটি সাকিব-রিয়াদ মিলে হেসেখেলে বের করে আনলেন। দু’জন করলেন জোড়া সেঞ্চুরি। অথচ কোনো আহামরি উদযাপন নেই। যেন এমনটি হবার ছিল। রিয়াদ চাইলেই এমন দু’চারটে ম্যাচ তুড়ি বাজিয়ে খেলতে পারেন। তাতে এত উল্লাসের কি আছে! আসলেই তো, গন্তব্য যখন সুদূরপ্রসারী, তখন সবকিছু নিজের মতো করে সাজিয়ে নেওয়াই ভালো। তাতে নিজের লক্ষ্যের থেকে সরে যাবার ভয় থাকে না। ক্রিকেট বাংলাদেশের ‘সাইলেন্ট কিলার’ খ্যাত মাহমুদুল্লাহ বোধহয় এমনি করে ভাবেন বলেই হয়তো তিনি অপ্রতিরোধ্য
সিটি২৪নিউজের ফেসবুক পেজে লাইক দিন
আমাদের ইউটিউব চ্যানেলে সাবস্ক্রাইব করুন